দ্বিতীয় অধ্যায় [সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা]
■ সঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো:
১.১ লালন ফকিরের গানগুলি প্রকাশিত হতো- (ক) গ্রামবার্তা প্রকাশিকা (খ) বামাবোধিনী (গ)হিন্দু প্যাট্রিয়ট (ঘ)দিগদর্শন-পত্রিকায়।
উত্তর: (ক) গ্রামবার্তা প্রকাশিকা-পত্রিকায়।
১.২ ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত-
(ক) মেকলে মিনিট (খ) উডের ডেসপ্যাচ (গ) হার্ডিঞ্জের ঘোষণা (ঘ) অকল্যান্ড মিনিট।
উত্তরঃ (খ) উডের ডেসপ্যাচ।
১.৩ জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন গঠিত হয়-
(ক) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে, (খ) ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে, (গ) ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে , (ঘ) ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে।
উত্তরঃ (খ) ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে।
১.৪ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন -(ক) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , (খ) কেশবচন্দ্র সেন , (গ) আনন্দমোহন বসু, (ঘ) অক্ষয় কুমার দত্ত।
উত্তরঃ (ঘ) অক্ষয় কুমার দত্ত।
১.৫ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয় -
(ক) ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে , (খ) ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে , (গ) ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে, (ঘ) ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে।
উত্তরঃ (খ) ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে।
১.৬ ব্রাহ্মসমাজের প্রথম আচার্য ছিলেন-
(ক) রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীস, (খ) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, (গ) কেশবচন্দ্র সেন, (ঘ) বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।
উত্তরঃ (ক) রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীস।
১.৭ একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র ছিল -
(ক) পার্থেনন, (খ) এথেনিয়াম, (গ) এনকোয়ারার , (ঘ) জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা।
উত্তরঃ (খ) এথেনিয়াম পত্রিকা।
১.৮ জীব জ্ঞানের শিব সেবার আদর্শ প্রচার করেন-
(ক) রামকৃষ্ণদেব, (খ) স্বামী বিবেকানন্দ, (গ) লালন ফকির , (ঘ) শঙ্করাচার্য।
উত্তরঃ (ক) রামকৃষ্ণদেব।
১.৯ বেদান্তের আদি ব্যাখ্যাকার হলেন-
(ক) স্বামী বিবেকানন্দ, (খ) রামকৃষ্ণদেব, (গ) স্বামীনারায়ণ, (ঘ) শঙ্করাচার্য।
উত্তরঃ (ঘ) শঙ্করাচার্য।
১.১০ বিধবা বিবাহ আইন পাস হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের-
(ক) ২৬ শে জুলাই, (খ) ২৬ শে সেপ্টেম্বর, (গ) ৪ঠা অক্টোবর , (ঘ) ৭ই ডিসেম্বর।
উত্তরঃ (ক) ২৬ শে জুলাই।
২. ঠিক/ভুল নির্ণয় করো:
২.১ সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকাটি সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করেছিল।
উত্তরঃ (ভুল)।
২.২ ব্রহ্মানন্দ অভিধা লাভ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
উত্তরঃ (ভুল)।
২.৩ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক হলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।
উত্তরঃ (ঠিক)।
২.৪ কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন মন্টফোর্ড ব্রামলি।
উত্তরঃ (ঠিক)।
২.৫ প্রথম বাঙালি সংবাদপত্র প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।(ঠিক)
৩. এককথায় উত্তর দাও:
৩.১ সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
৩.২ ধর্মতলা একাডেমি কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর: ধর্মতলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন ডেভিড ড্রামন্ড।
৩.৩ ব্রাহ্মসমাজে প্রথম কবে ভাঙন সৃষ্টি হয়?
উত্তর: ব্রাহ্মসমাজে প্রথম ভাঙন সৃষ্টি হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে।
৩.৪ নীলদর্পণ নাটকটি প্রথম কোথা থেকে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: নীলদর্পণ নাটকটি প্রথম ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।
৩.৫ ফোর্ড উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন লর্ড ওয়েলেসলি।
৩. দু-তিনটি বাক্যে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।
৩.১ বাংলার নারী শিক্ষা বিস্তারে রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: রাধাকান্তদের প্রাচ্য শিক্ষা কাঠামোয় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। শুরুটা তিনি নিজে গৃহ থেকেই করেছিলেন। ঘরের নারীদের পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ইংরেজি শিক্ষিকা নিয়োগ করেন তিনি।
নারী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য ডব্লিউ এইচ পিয়ার্সকে পত্র দ্বারা অনুরোধ জানান রাধাকান্ত। এই কাজের তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলো ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে 'স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক' নামে পুস্তিকা প্রকাশ।
৩.২ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হল কেন?
উত্তর: ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বিভাজনের কারণ:
ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন-এর অতিরিক্ত খ্রিস্টান ও ইংরেজ প্রীতি, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সাহচর্যে এসে হিন্দু ধর্মের প্রতি আসক্তি, নারী শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞা, নীতিগতভাবে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের নাবালিকা কন্যার বিবাহদান প্রভৃতি ঘটনায় প্রগতিপন্থী যুব ব্রাহ্মনেতারা কেশবচন্দ্রের তীব্র বিরোধিতা করে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করএন। একারণে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মসমাজ বিভাজিত হয়।
৩.৩ মেকলে মিনিট কী?
উত্তর: মেকলে মিনিট:
জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি সরকারের নিকট যে প্রতিবেদন পেশ করেন তা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত।
মেকলে তাঁর এই প্রতিবেদনে রক্তে-মাংসে গড়া মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজদের মতো রুচি ও চিন্তার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন।
৩.৪ সমাজ সংস্কারের নব্যবঙ্গীয় দের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: সমাজ সংস্কারের নব্যবঙ্গীয় দের ভূমিকা:
কলকাতা হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও তাঁর অনুগামী ছাত্রদের নিয়ে প্রগতিপন্থী নব্যবঙ্গ দল গঠন করেন।
নব্যবঙ্গ দলের সদস্যরা হিন্দু সমাজে প্রচলিত নানাবিধ কুসংস্কার দূরীকরণ, নারীশিক্ষার প্রসার, আধুনিক যুক্তিবাদের প্রসার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান সহ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের স্বপক্ষে আন্দোলন করে এক আধুনিক সমাজ গঠনে প্রযাসী হয়েছিলেন।
৩.৫ মধুসূদন গুপ্ত কে ছিলেন?
মধুসূদন গুপ্ত:
মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন, হুগলির বাঙালি হিন্দু বৈদ্য পরিবারের একজন খ্যাতিবান চিকিৎসক ও অনুবাদক।
প্রথম ভারতীয় হিসেবে মধুসূদন গুপ্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাক্তার হেনরি গুডিভ-এর তত্ত্বাবধানে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে শবব্যবচ্ছেদ করে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
৩.৬ এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: এদেশে (ভারতে) পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি, চার্চ মিশনারি সোসাইটি প্রভৃতি সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে মিশনারীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল- (১) পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে ভারতীয়দের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের বাণী প্রচার করা।
(২) ভারতীয়দের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
৩.৬ নববিধান কী?
উত্তর: নববিধান:
আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বিভাজিত হবার পর ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শে ব্রাহ্মসমাজে যে নতুন ধর্মতত্ত্বের উদ্ভাবন ঘটান তা নববিধান নামে পরিচিত।
নববিধান আদর্শের উপর ভিত্তি করে কেশবচন্দ্র সেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজ (১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে) প্রতিষ্ঠা করেন।
৩.৭ স্কুল বুক সোসাইটি কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: মহাত্মা ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠার মূল কারণ ছিল-
(১) সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা।
(২) দুস্থ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুস্তক ও অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রী স্বল্পমূল্যে বিতরণ করা।
৩.৮ লর্ড হার্ডিঞ্জ এর শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশনামা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: লর্ড হার্ডিঞ্জের ঘোষণার গুরুত্ব:
ভারতের ব্রিটিশ শাসক লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শিক্ষাবিষয়ক নির্দেশনামা জারি করেন।
হার্ডিঞ্জের শিক্ষা নির্দেশিকায় ইংরেজি ভাষারজ্ঞানকে সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। এর ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায় ইংরেজি শিখে সরকারি চাকুরীজীবীতে পরিণত হয়। এই কারণে লর্ড হার্ডিঞ্জের শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশনামা গুরুত্বপূর্ণ।
৩.৯ বাংলার নবজাগরণ বলতে কী বোঝো?
উত্তর: ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে উনিশ শতকের বাংলায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সামাজিক জীবনে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের উন্মেষের ফলে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় তা, বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত।
বাংলার নবজাগরণের ফলে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।
৩.১০ নব্য বেদান্তবাদ কী?
উত্তর: বেদের শেষভাগ বেদান্ত নামে পরিচিত। এই বেদান্তের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হলো জগতের সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি ব্রহ্ম সম্পর্কিত আলোচনা।
আদি বেদান্তের মহান ব্যাখ্যাকার শংকরাচার্যের মতে, ''ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা।" পরবর্তীতে বেদান্তের নব্য ব্যাখ্যাকার স্বামী বিবেকানন্দ অভিমত প্রকাশ করেন যে, জগতের প্রতিটি জীবের মধ্যে ব্রহ্মার উপস্থিতি বিদ্যমান। বেদান্ত সম্পর্কিত স্বামীজীর এই তত্ত্বই নব্য বেদান্তবাদ নামে পরিচিত।
৩.১১ প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী কারা?
উত্তর: ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতে সরকারি শিক্ষার নীতি নির্ধারণের জন্য ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়
ভারতের সরকারি শিক্ষানীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে গঠিত জনশিক্ষা কমিটি (১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ)-র যে সকল সদস্যরা ভারতে দেশীয় রীতিতে (অর্থাৎ সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ইত্যাদি) শিক্ষা বিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন তাঁরা প্রাচ্যবাদী নামে পরিচিত। উইলসন, হেনরি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক ছিলেন প্রাচ্যবাদীদের মধ্যে অন্যতম।
অপরদিকে জনশিক্ষা কমিটির যে সকল সদস্যরা পাশ্চাত্য রীতিতে (ইংরেজি ভাষায়) এদেশে শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে মত প্রদান করেন তাঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত। মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্যবাদের সমর্থক।
৩.১২ জনশিক্ষা কমিটি কী উদ্দেশ্যে গঠিত হয়?
উত্তর: জনশিক্ষা কমিটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য:
ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা এদেশে শিক্ষা বিস্তারে মনোযোগী হয়। এমতাবস্থায় ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় জনশিক্ষা কমিটি (G.C.P.I)। এর উদ্দেশ্য ছিল-
(১) ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ঘোষিত ১ লক্ষ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হবে (প্রাচ্য না পাশ্চাত্য), তা স্থির করা। (২) ভারতে জনশিক্ষার নীতি নির্ধারণ করা। ইত্যাদি।
৪. প্রশ্নমান-৪
প্রশ্নঃ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা থেকে শতকের বাংলার সমাজের কিরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায়?
ভূমিকা:
উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যেসকল সাময়িকপত্রে সমকালীন বাংলার সমাজ জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলীর প্রতিফলন ঘটেছিল গ্রামবার্তা প্রকাশিকা ছিল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হরিনাথ মজুমদার (কাঙ্গাল হরিনাথ) কর্তৃক ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার গিরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা মাসিক পত্রিকার রূপে প্রথম প্রকাশিত হয়।
● গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সমাজের প্রতিফলন :
(১) গ্রামীণ সমাজের প্রতিচ্ছবি:
আলোচ্য গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় সমকালীন বাংলার গ্রামবাসীদের অবস্থা, তাদের কর্ম সম্পাদন প্রক্রিয়া, গ্রাম্য সংস্কৃতি ও নিত্যদিনের নানাবিধ ঘটনাবলীর কাহিনী প্রকাশিত হতো।
(২) জমিদারি শোষণের উল্লেখ:
গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের উপর প্রতিনিয়ত জমিদার ও সহযোগী মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের বর্ণনা ফুটে উঠতো গ্রামবার্তা প্রকাশিকায়। হরিনাথ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন-গ্রাম বাংলার প্রথম অত্যাচারকারী জমিদার।
(৩) সরকারি নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ:
পত্রিকা সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ সমকালীন বাংলার সাধারণ মানুষের উপর হওয়া ব্রিটিশ পুলিশ নীলকর সাহেব ও মফসলের রাজ কর্মচারীদের অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের কথা সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন
(৪) বাউল সংস্কৃতির প্রতিপালন:
গ্রাম বাংলার লোকসংস্কৃতিকে নিয়ে গড়ে তোলা লালন ফকিরের বাউল গানগুলি উক্ত পত্রিকায় পরিবেশিত হত।হরিনাথ নিজেও ছিলেন বাউল গানের একজন সুপরিচিত সাধক। জনসমক্ষে তিনি নিজেকে ফকির চাঁদ বাউল নামে পরিচয় প্রদান করতেন।
● মূল্যায়ন:
উনিশ শতকে প্রকাশিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি ছিল সমকালীন বাংলার সাধারণ মানুষের কন্ঠ। গ্রামীণ সমাজের যথার্থ প্রতিচ্ছবি প্রদর্শনের কারণে পত্রিকাটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় উত্তীর্ণ।
প্রশ্নঃ উনবিংশ শতকের বাংলায় নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের কী ভূমিকা ছিল?
● ভূমিকা:
উনিশ শতকের বাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারে যে সকল মনীষী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।
বিদ্যাসাগরের গৃহীত পদক্ষেপ গুলি পর্দাপ্রথার আড়ালে ঢেকে থাকা নারীদের উচ্চ শিক্ষা লাভের পথ প্রশস্ত করেছিল।
◆ বিদ্যাসাগরের উপলব্ধি:
বিদ্যাসাগরের মতে, একমাত্র শিক্ষার দ্বারাই নারী সমাজকে প্রকৃত রূপে আধুনিক ও কুসংস্কার মুক্ত করা সম্ভব। স্ত্রী জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে না পারলে আমাদের সমাজ,সভ্যতা ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবেনা।
● নারী শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের গৃহীত পদক্ষেপ:
বিভিন্ন সফল উদ্যোগ গ্রহণ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী জাতিকে শিক্ষিত করতে সচেষ্ট হন। যেমন -
(১) বেথুন সাহেবের সহযোগিতা লাভ:
জন শিক্ষা কমিটির সভাপতি ড্রিংক ওয়াটার বেথুন এর সহযোগিতায় বিদ্যাসাগর , কলকাতায় দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এর বাড়িতে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল (বর্তমান স্কুল )। উক্ত বিদ্যালয়ে অবৈতনিক সম্পাদক থেকে। নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটান বিদ্যাসাগর।
(২) প্রচার কার্য সম্পাদন:
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কথা মাথায় রেখে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রচার অভিযান চালান বিদ্যাসাগর । বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের জন্য ব্যবহৃত গাড়িতে তিনি প্রচার করেন- কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়তি যত্নতঃ"। অর্থাৎ, পুত্রের ন্যায় কন্যাকেও যত্ন সহকারে পালন শিক্ষাদান করতে হবে।
(৩) নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়ে স্থাপন:
বাংলার ছোটলাট হ্যালিড কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শক থাকাকালীন সময়ে বিদ্যাসাগর মেদিনীপুর, হুগলি , বর্ধমান জেলায় মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিভিন্ন জেলায় 'স্ত্রীশিক্ষা সম্মিলনী' স্থাপন করে তিনি স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার ঘটান। মায়ের নামে ভগবতী বিদ্যালয় ছিল তার সর্বশেষ প্রচেষ্টা।
(৪) তহবিল গঠন :
নারী শিক্ষা বিস্তারের কর্মযজ্ঞে সরকারি অর্থ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন বিদ্যাসাগর । তাই বিদ্যালয়গুলির পঠন-পাঠন প্রক্রিয়া সচল রাখতে তিনি নিজ উদ্যোগে 'নারী শিক্ষা ভান্ডার' নামে তহবিল গঠন করেন।
● মূল্যায়ন:
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে তার নারী শিক্ষা প্রচারকারকার্যে। " যেখানে নারীরা সম্মানিত হয়, সেখানে ঈশ্বর বাস করেন"-এই ছিল তার অভিমত।
প্রশ্নঃ উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কারে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ভূমিকা আলোচনা কর।
■ সমাজ সংস্কারে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ভূমিকা:
● ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেসব আন্দোলন সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, নববঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন ছিল তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কলকাতা হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুইভিয়ান ডিরোজিও ও তার অনুগত ছাত্রদের নিয়ে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল।
● নব্য বঙ্গ গোষ্ঠীর মতাদর্শ:
হিন্দু সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে যুক্তিবাদ ও মুক্ত চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়ে এক উন্নত সমাজ গঠন করা ছিল নব্য বঙ্গ গোষ্ঠীর প্রধান উদ্দেশ্য।
● একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা:
বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তা বিকাশের লক্ষ্যে, ডিরোজিও ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এথেনিয়াম পত্রিকার দ্বারা প্রচার কার্য চালিয়ে আধুনিক সমাজ গঠনের কাজ করতো উক্ত সংগঠন।
● পত্র-পত্র পত্রিকা প্রকাশ:
ডিরোজিও ও তার ছাত্রগণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতেন। পার্থেনন, ক্যালাইডোস্কোপ, জ্ঞানান্বেষন, হেসপোরাস, এনকুয়েরার প্রভৃতি পত্রিকা মারফত বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করত নব্যবঙ্গীয়রা।
● নারী স্বাধীনতা:
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পার্থেনন পত্রিকার মধ্য দিয়ে নব্যবঙ্গ দলের সদস্যরা স্ত্রী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তোলে।
● জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা:
নব্য বঙ্গ গোষ্ঠী বিভিন্ন কার্যকলাপের দ্বারা প্রচলিত সমাজের জাতিভেদ প্রথার মূলে কুঠারঘাত করে। অস্পৃশ্যতা দূর করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল গোষ্ঠীর অন্যতম মূল লক্ষ্য।
● ধর্মীয় চিন্তা:
মূর্তি পূজা, সতীদাহ প্রথা ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠনের পথনির্দেশিকা দেন নব্য বঙ্গ দলের সদস্যরা।
● মন্তব্য:
নব্য বঙ্গ গোষ্ঠীর উদ্ভাবক ডিরোজিওর অকাল মৃত্যুতে নব্য বঙ্গ আন্দোলনের কার্যকলাপে কিছুটা ভাটা পড়লেও কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রমুখরা দলের কার্যকলাপকে কিছুকাল এগিয়ে নিয়ে যান। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় জনসমাজকে যুক্তিবাদের পথে পরিচালনায় নব্য বঙ্গ গোষ্ঠী সফল হয়েছিল।